রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র ফার্মগেটের খামার বাড়িতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে বসেছিল বইয়ের মানুষদের মিলনমেলা। বইপ্রেমীরা সকল ব্যস্ততা ফেলে ছুটে এসেছিলেন অনলাইন বই বিপণন সংস্থা রকমারি ডট কমের নিমন্ত্রণে।
দেশবরেণ্য লেখক, প্রকাশক ও পাঠকরা একজোট হয়ে উদযাপন করেছেন নগদ-রকমারি বইমেলা বেস্টসেলার অ্যাওয়ার্ড ২০২৩ অনুষ্ঠান। কেআইবি অডিটোরিয়ামের বাইরেও আকাশ মুখরিত হয়েছিল বইপ্রেমীদের উল্লাসে। বই নিয়ে আলোচনা, আলোকিত লেখকদের সরব উপস্থিতি, বই উপহার দেয়া নেয়া যেন বইউৎসবে পরিণত হয়েছিল। ভবিষ্যতে বই নিয়ে এমন সুন্দর আয়োজন আরো বড়ো পরিসরে হবে এমন আশা প্রকাশ করেছে অংশগ্রহণকারী অনেকেই। বিআইআইটি এর একটি প্রতিনিধি দলও উপস্থিত হয়েছিলেন বই ও বইয়ের মানুষদের সেই মিলনমেলায়।
২০২২ সালের এপ্রিল থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত রকমারি থেকে সর্বোচ্চ বিক্রিত বইয়ের লেখকদের দেওয়া হয় নগদ-রকমারি বইমেলা বেস্টসেলার অ্যাওয়ার্ড ২০২৩। ফিকশন, নন ফিকশন, ধর্মীয় এবং ক্যারিয়ার ও একাডেমিক- এ চার শাখায় রকমারিতে সর্বোচ্চ বিক্রি হওয়া বইয়ের ৪ জন লেখক ও ৪টি বইকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। এ ছাড়া একইসঙ্গে ২১টি ক্যাটাগরির ২১ জন লেখক ও ২১টি বইকেও সম্মাননা জানানো হয়।
ফিকশন বিভাগে বেস্টসেলার লেখক হিসেবে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন জনপ্রিয় তরুণ তাসরিফ খান। একই বিভাগে বেস্টসেলার বই ছিল কিংবদন্তী পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত বাইশের বন্যা। নন-ফিকশন শাখায় বেস্টসেলার লেখক হিসেবে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন মুহাম্মদ ইলিয়াস কাঞ্চন। নন-ফিকশন বিভাগে বেস্টসেলার বই হিসেবে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে পেয়েছে আদর্শ থেকে প্রকাশিত বিজনেস ব্লুপ্রিন্ট।
ধর্মীয় বিভাগে বেস্টসেলার লেখক হিসেবে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন আরিফ আজাদ। একই বিভাগে বেস্টসেলার বই হয়েছে সত্যায়ন থেকে প্রকাশিত ‘কুরআন থেকে নেওয়া জীবনের পাঠ’। ক্যারিয়ার ও অ্যাকাডেমিক ‘ম্যাজিক ম্যাথ’ বই লিখে অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন মোত্তাসিন পাহলভী। ইনফিনিটি পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত তার বইটিও একই বিভাগে বেস্টসেলার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে।
এ ছাড়া বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বেস্টসেলার হয়েছেন উপন্যাসে সাদাত হোসাইন, সায়েন্স ফিকশনে মুহম্মদ জাফর ইকবাল, কমিক ও রম্যতে অস্তিক মাহমুদ, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধে আসিফ নজরুল, জীবন ইতিহাসে মহিউদ্দিন আহমদ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মুহম্মদ আনোয়ার হোসেন ফকির, আত্ম-উন্নয়ন ও মোটিভেশনে প্রিতম মুজতাহিদ, বিবিধ শাখায় ড. আমিনুল ইসলাম, কুরআন ও হাদিসে জোবায়ের আল মাহমুদ, ইসলামি ইতিহাস-ঐতিহ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদ, ইসলামী আদর্শ ও মতবাদে মিরাজ রহমান, ভাষা ও অভিধানে সাইফুল ইসলাম এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ভর্তি শাখায় বিজ্ঞানবিদ্যা টিম।
অনুষ্ঠানে লেখকদের পাশাপাশি বেস্ট সেলার বইয়ের প্রকাশকদেরও অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। পুরস্কারপ্রাপ্তদের হাতে ক্রেস্ট ও সনদ তুলে দেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের মাননীয় মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফা জব্বার।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মোস্তাফা জব্বার বলেন, বইয়ের মত বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারা পরম আনন্দের বিষয়। বই নিয়ে পিছিয়ে থাকা একটা জাতি আমরা। তবে আমাদের জন্য আনন্দের বিষয় এটা, বাংলাদেশের একটা ইকমার্স কোম্পানি তাদের পণ্য হিসেবে বই নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রকমারি মানেই বই বিক্রির প্রতিষ্ঠান। একসময় বাংলাদেশে বই বিক্রির জন্য লেখক ও প্রকাশকদের যে দুশ্চিন্তা ছিল সেই দুশ্চিন্তা দুর করেছে রকমারি ডট.কম। প্রকাশকদের জন্য সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ বই বিক্রি করা। সেই কাজটি সহজ করে দিয়েছে রকমারি ডট কম। রকমারি প্রতিবছর যে বেস্ট সেলার এয়ার্ড দেয় এটি লেখক ও প্রকাশকদের আরো উৎসাহিত করে। এমন প্রগ্রামের জন্য রকমারিকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, দিন দিন প্রযুক্তির ব্যাবহার বাড়ছে। এখন মাত্র ৩০ টি দেশে রকমারি বই পৌছে দিচ্ছে। সামনের দিনে রকমারি সারা পৃথিবীর মানুষেরর কাছে বাংলা বই পৌছে দিতে কাজ করবে বলে আমি আশা করছি। এখন অনলাইনে বইয়ের পাইরেসি হচ্ছে। আমাকে দিনে অনেকেই জানান, কোথাও কোথাও বইয়ের পিডিএফ বিক্রি হচ্ছে। আপনারা যদি এমনটা দেখেন, আমাদের জানাবেন। আমি আমার সাধ্যের মধ্যে সবটুকু চেষ্টা করব ডিজিটাল দুনিয়ায় বইয়ের পাইরেসি বন্ধ করতে। ই-বুক নিয়ে যদি কেউ পাইরেসি করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন বলেন, `আজকের প্রগ্রামে যে স্লোগান বইয়ে বইয়ে সয়লাব হোক ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল, এই স্লোগানের মত আমিও বলতে চাই সারাদেশের মানুষের কাছে খুব সহজেই বই পৌছে যাক। জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হোক সারা দেশের মানুষ।
কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, একটা সময় আজিজ সুপার মার্কেট, নিউ মার্কেট, শাহবাগসহ বিভিন্ন নামিদামি জায়গায় বইয়ের দোকান থাকলেও তা ধীরে ধীরে বিভিন্ন কারণে হারিয়ে গেছে। সেই জায়গাটা দখল করেছে অন্যকিছু। ফলে যারা বই পড়েন, তারা খুঁজে খুঁজে বই এনেছেন বিভিন্ন জায়গা থেকে। সেদিক থেকে বই আহরণের কাজটিকে সহজ করেছে রকমারি। অন্যান্য পণ্য আনলেও বইয়ের প্রতি তাদের যেন আলাদা নজর থাকে, তার জন্য আলাদা প্রত্যাশা থাকবে।
রকমারি ডট কমের চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান সোহাগ বলেন, পাবলিশাররা একসময় আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করত, কিন্তু এখন তারা আমাদের বন্ধু মনে করেন, এটিই আমাদের সফলতা। আমরা শুরু থেকে গুটি গুটি করে এগিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশের বাইরেও ৩০টি দেশে আমরা এখন বই পাঠাচ্ছি। বিশ্বের যে কোন প্রান্তের মানুষ যাতে রকমারি থেকে বই কিনতে পারে সেই উদ্যোগ নিচ্ছে রকমারি ডট.কম। গত ১২ বছর ধরে আমরা যে চেষ্টা করছি সেই চেষ্টার সফলতা বিফলতা দুটি বিষয়ই আছে। এতদিন মনে করা হতো যে রকমারি একটা প্ল্যাটফর্ম যারা বই ডেলিভারি করি। তবে আগামীতে পাবলিশার ও লেখকদের নিয়ে পাঠকদের দোরগোড়ায় বই পৌছে দেওয়ার জন্য যত রকম চেষ্টা করার দরকার আমরা করে যাচ্ছি। সকলের সহযোগিতায় রকমারি আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবে বলে মনে করি। আগামীতে আমরা ই-বুক, অডিও বুক আনতে যাচ্ছি।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে একুশে পদকপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক, কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৌমিত্র শেখর,বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রয় সমিতির সহ-সভাপতি শ্যামল পাল, নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ মিশুক সহ অনেকেই বক্তব্য দেন।
অনুষ্ঠানের টাইটেল পার্টনার ছিল ডাকবিভাগের ডিজিটাল লেনদেন নগদ। পাওয়ার্ড বাই ইস্পাহানি এবং গিফট পার্টনার ছিল কেয়ার নিউট্রিশন, ন্যাচারালস, অর্গানিকাওন, সেভেন ডেজ নোটস ও যাদরো ডট কম। লাইভ কুইজ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়, তাতে ৩০ জন দর্শককে পুরস্কৃত করা হয় এবং আয়োজনের শেষে অনুষ্ঠিত হয় র্যাফেল ড্র। এতে অনুষ্ঠানে আসা দর্শক ও অতিথিদের মধ্য থেকে ১৫ জনকে পুরস্কৃত করা হয়।